বংশে কেউ কখনো মাথা খাটিয়ে দু চার কলম লিখেছে বলে শোনা যায়নি। লেখালেখি যেটুকু করেছে তা ঐ পরীক্ষা পাশের জন্য। তারপর কয়েক ক্লাস পাশ দিয়েই সংসারের ঘানি ঘাড়ে নিতে হয়েছে। শান্তর বাপ যে কিভাবে দুই খানা বোর্ড পাশ দিলো সেটা আজো অত্র এলাকার একটি আঞ্চলিক রহস্য হয়ে আছে। হোক সে সেকেন্ড ক্লাস। শান্তর বাপ সরকারী অফিসে চাকরি করে। ছেলেদের লেখাপড়া শেখাতে গ্রাম ছেড়ে থানা সদরে বাসা ভাড়া থাকে। সে অনেক দিন হয়ে গেলো। তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেলো পশুর নদী দিয়ে। অনেক ইলিশ ধরা পড়লো জেলেপাড়ার জেলেদের জালে। অনেক লাকড়ি পুড়লো শান্তর মায়ের রান্নাঘরের মাটির চুলায়।
আজকাল ছেলেরা সারাক্ষণ ফেসবুকে চোখ মেলে বসে থাকে আর শান্ত পোকার মত বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে। নানারকম বই পড়ে সে। আজকাল গল্প উপন্যাসটাই বেশী পড়া হচ্ছে। ক্লাস টেনের ছাত্র সে, বঙ্কিমের বাংলায় দাঁত ভেঙে যায় বলে তাঁকে সযতনে পাশ কাটিয়ে চলে। রবীন্দ্রনাথও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না। খুবই হাইথটের লেখা। তার একই লেখা একেক সময়ে একেক অর্থ হয়ে ধরা দেয়। শরৎ, বিভূতি পেরিয়ে এখন সে হুমায়ুনে মজে আছে। শরৎ সাহেব সম্পর্কের রসায়ন বর্ণনার ওস্তাদ। অন্যদিকে রসায়নে শিক্ষক হুমায়ুন আহমেদের আছে কঠিনকে সহজ করে বলার এক সহজাত ক্ষমতা। আবার বিভূতিভূষনের মত প্রকৃতি দেখার চোখ আর কোন লেখকের আছে বলে মনে হয় না। তার বর্ণনা পড়লে চোখের সামনে সব বিমূর্ত ছবি হয়ে ফুঁটে ওঠে। এক পথের পাঁচালিই সে পড়েছে বত্রিশবার।
শান্ত গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। বড় আপা স্টিলের চ্যাপ্টা বাটিতে করে এক বাটি জাম দিয়ে গেছেন। চিন্তামগ্ন অবস্থায় বাটির জামগুলো কিভাবে বিঁচিতে রূপান্তরিত হলো সে বিষয়টাও কিন্তু কম চিন্তাযোগ্য নয়! আজকাল জামের বিঁচিও ফেলনা নয়। বুধবার সাপ্তাহিক হাটের দিন বনজী ঔষধের ক্যানভাস করতে আসা মকসুদ কবিরাজ হাত মাইকে লেকচার দেয়, ‘মা বোনেরা সকাল বেলা ঝাড়ু দিয়ে জামের বিঁচি ফেলে দেবেন না। জামের বিঁচি এখন আর ফ্যালনা নয়। ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়’।
কবি সাহিত্যিকদের বই পড়তে পড়তে শান্তর হঠাৎ লেখক হওয়ার খায়েস হলো। তার নামও বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরা স্বশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করবে! কথাটা সে কাউকে বলতে পারে না। বড় আপাকে বলেছিলো। বড় আপা কিছুটা ঠাট্টা করলো বলে মনে হলো। বললো পড়াশোনা বাদ দিয়ে কবিতা লেখ , সামনের এসএসসিতে ডাব্বা মার তাহলে বড় কবি হতে পারবি! বড় আপাটা যে কি! মনে হয় পরীক্ষায় ডাব্বা মারা লোকেরাই শুধু বড় বড় কবি সাহিত্যিক হয়! লিডারকে বলা যায়। লিডার হচ্ছে ক্লাসের সব থেকে ভালো ছাত্র। সারা বছর বাঁদরামি করে বেড়ালেও বছর শেষে ঠিকই ভালো রেজাল্ট করে। লিডারের অন্যকে ছোট করে কথা বলার বদ অভ্যাস আছে। কোন টপিকস পেলেই খোঁচা মারে। বল্টুকে বলা যায়। বল্টু হচ্ছে শান্তর সব থেকে কাছের বন্ধু। বল্টুর আসল নাম রাশেদ শিকদার। খুলনার এরশাদ শিকদারের সাথে তার কোন যোগসূত্র না থাকলে ক্লাসের বন্ধুরা তাকে ছোট শিকদার নামে ডাকে। ছোট শিকদার ছাপিয়ে এখন ডাকে বল্টু শিকদার। হাইট একটু কম থাকায় বল্টু নাম ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। ওর বাড়িতে পর্যন্ত অনেকের বল্টু নামে ডাকে। বল্টু নামে ডাকলেও সে ডাক শোনে। রাশেদের মায়ের সামনে ভূল করে কেউ যদি বল্টু বলে ডেকে বসে তাহলে তিনি কিছু বলেন না। শুধু কটমট চোখে তাকান।
লোকে বলে খাটো লোকের বুদ্ধি বেশী। ঠিকই বলে। বল্টু তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বল্টুর বুদ্ধিতে শান্ত কবিতা লেখার প্রকল্প হাতে নিলো। শান্তর কবিতা সম্পর্কে অগাধ আস্থা। তার ধারণা ছিলো কবিতার শেষে অন্তমিল থাকলেই কবিতা হয়ে যায়। সে দুই লাইন ছড়া স্বভাব কবিদের মত তৎক্ষণাৎ বানিয়ে ফেলার অসাধারণ প্রতিভা অর্জন করেছে। যেমন,
খাচ্ছো তুমি কি
পান্তাভাতে ঘি।
লিডার শান্তর এই কাব্যপ্রতিভার চরম অবমূল্যায়ণ করে। বলে পল্লীকবি উপাধি তো পাবিনা। সেটা জসীম উদ্দিনকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। তুই পাবি পাড়াকবি টাইটেল। পাড়াকবি শান্ত সরদার। পাড়ায় পাড়ায় তোকে কবিতা পড়তে দাওয়াত দেয়া হবে! তুই কবিতা পড়বি,
কুকুর নাড়ে লেজ, দেখ আমার কবিতার তেজ!
তুমি খাও গরু, আমিও কিন্তু ভাই নন-ভেজ!
পদ্মা সেতু প্রকল্পের মত এই প্রকল্পে কোন দূর্ণীতি না হওয়া সত্বেও সপ্তাহ পেরোতেই কবিতা প্রকল্প পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলো। বল্টুর মহতী পরামর্শ সত্বেও সে কবিতাকে ঘাড়, মাথা, হাত সব লাগিয়েও দুই লাইন থেকে চার লাইনে উত্তোলন করতে সমর্থ হলো না। তার থেকে গল্প লেখা ঢের সোজা, শুধু লাইনের পর লাইন কহিনী সাজিয়ে নিলেই হলো!
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত আসে। পাখিরা ঘুমিয়ে পড়ে। বিটিভিতে রাত আটটার খবর শুরুর আগে চিরচেনা সেই টিউন বাজে। শান্ত এ ফোর সাইজের সাদাকাগজের জমিনে কলমটা চেপে ধরে বসে আছে। লেখার মত কোন গল্প খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাথা চিনচিন করছে। ধ্যুর! গল্প লেখাও দেখি সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথ পাতার পর পাতা গল্প কিভাবে লিখত ? গল্পগুচ্ছে এত এত গল্প লেখার রসদ পেলো কোথায়? আইডিয়া! রবী ঠাকুর জমিদারী কাজে বিভিন্ন জায়গায় যেত। শিলাইদহ, শাহজাদপুর, কুষ্টিয়া, কলকাতায় বিভিন্ন মানুষের সাথে পরিচয় হত। সেগুলোকেই গল্প আকারে চালিয়ে দিত। শান্তকে এরকম মানুষের সাথে মিশে তাদের গল্পটা জেনে নিতে হবে। ব্যাপারটা বল্টুকে বলাতে সেও উৎসাহে লাফিয়ে উঠলো। কিন্তু মুশকিল হলো গল্প শোনার মত সেরকম কাউকেই খুঁজে পেলো। আশেপাশে সব চেনা মানুষজন। খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে, বাজার করছে, ঝগড়া করছে, অফিস যাচ্ছে। এদের জীবনে আবার কোন গল্প আছে নাকি! দাদুর কাছ থেকে গল্প শোনা যায়। কিন্তু তিনি তো সেই এক ঘেঁয়ে গল্প করেন, এক দেশে ছিলো এক রাজা...।
কয়েক দিন পরে বল্টুই সমাধানের দ্যূত হয়ে খবর দিলো গাছতলায় নাকি কোন জায়গা থেকে এক সাধুবাবা এসেছে। দেশ বিদেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা তার। তার কাছ থেকে বিভিন্ন কাহিনী শুনে গল্প লিখতে পারবে শান্ত। স্বস্তির হাসি ফুটলো শান্তর ঠোঁটে।
পা চালিয়ে হাঁটলে বাড়ি থেকে গাছতলা দশমিনিটের পথ, দুপুরে খাওয়া সেরে দুজন গাছতলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। জায়গাটাকে সবাই বঊমার গাছতলা বলে। বড়সড় একটা বটগাছ ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কবেকার কার বঊমার গাছ ছিলো সে ইতিহাস কেউ মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। খাল পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলো এক জায়গায় বেশ কিছু মানুষের জটলা। খালের নিথর পানির দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। খবর নিয়ে জানা গেলো এটা বিশ্বকাপ উত্তেজনার ফসল। কয়েক আগেই বিশ্বকাপ ২০১৪ শুরু হয়েছে ব্রাজিলে। তার রেশ এখন পুরো বাংলা জুড়ে। চারদিকে এখন বিভিন্ন দেশের পতাকা। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার পতাকাই বেশী। জার্মানী আর ইতালিরও আছে কয়েকটা। খেয়াঘাটের সামনের এক দোকানের দেয়ালে কে যেন অপটু হাতে চিলির একখানা পতাকা আঁকিয়ে রেখেছে। নিচে বাঁকাচোরা অক্ষরে লেখা সৌজন্যে, মইদুল ইসলাম। অক্ষর বাঁকা হতে পারে আবেগ কিন্তু বাঁকা নয়। যারা বলে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার পতাকা টাঙালে দেশপ্রেম কমে তারা মুর্খ বই কিছু নয়। এখানে কেউ দেশের পতাকা টাঙায় না। টাঙায় প্রিয় দলের পতাকা। তারা ব্রাজিল দেশকে জানেনা। তারা জানে দল ব্রাজিলকে। পেলে , রোনালদো, নেইমারকে। ওপাশে বড় চটকা গাছের নিচে যে চৌচালা টিনের ঘর, ওটা রহিমুদ্দি শেখের বাড়ি। শেখ করে ব্রাজিলের সাপোর্ট আর তার ছেলে করে আর্জেন্টিনা। উদ্বোধনী ম্যাচেই জাপানের রেফারি নিশিমুরো এক বিতর্কিত পেনাল্টি দিয়েছে ব্রাজিলকে। বিশ্বের সকল ব্রাজিল সমর্থক ফ্রেডের সাথে সুর মিলিয়ে বলবে এটা পেনাল্টি। অন্যদিকে হাত দিয়ে গোল করা নিয়ে গর্ব করা আর্জেন্টাইন সমর্থকদের মত তুমুল বিদ্রুপ শুরু করে ছেলে। বাপের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। জোয়ান ছেলেকে তো আর ছেলেবেলার মত ঠাঙানী দেয়া যায় না। চেলা কাঠ হাতে নিয়ে রাগ ঝাড়ে নিরীহ টিভিটার উপর। তাতেই সে ক্ষান্ত হয়নি। ভাঙা টিভিটাকে রাস্তা পার করে খালে ছুঁড়ে ফেলে গেছে। হয়তো পুটিমাছেরা এখন ডুবে যাওয়া টিভির ফ্রেমের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। জনসমাগম সেটা নিয়েই গবেষণা করছে কিনা সেটা নিয়ে তারা মাথা ঘামালো না।
শান্তরা এগিয়ে যায়। তাদের আগে আগে ভটচার্য্যি মশাই যাচ্ছেন। ভটচার্য্যি মশাই এই এলাকার নামকরা ব্রাম্মণ। পূজো পার্বণে সদ্য ইস্ত্রি করা কড়া মাড় দেয়া ধূতি পরে মাথায় চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে মন্ত্রপাঠে বসে যান। রাস্তার মাঝখানে একটা সারমেয় সন্তান দাঁড়িয়ে নিজের পশ্চাৎদেশ কামড়ানোর চেষ্টা করছে। তিনি ছেই ছেই করে কুকুরটিকে তাড়িয়ে দিলেন। ভটচার্য্যিমশাই খুব শুচিবায়ু টাইপের লোক। কুকুরটি দৌড়ে সরে গেলো পাশের ঝোপের আড়ালে। তিনি কুকুরের দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাটা না মাড়িয়ে পা বাঁচিয়ে চললেন। কিছুদূর যেতেই খালের পানিতে একটা মাটির ভাঁড় উপুর হয়ে ভাসতে দেখা গেলো। বল্টুর হাত নিশপিশ করতে লাগলো। মাটির একটা ঢেলা তুলে নিয়ে ভাঁড়টার দিকে তাক করে লক্ষ্যভেদ করার উদ্যোগ নিতেই শান্ত তার হাত চেপে ধরলো। আরে করছিস কি! এটা ভাড় নয়। করিম গাজীর বৃদ্ধ বাপের টাক। সব চুল পড়ে গেছে বলে দূর থেকে দেখলে এরকম মনে হয়। জৈষ্ঠের ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে বৃদ্ধ গলা পানিতে নেমে দাঁড়িয়ে আছে।
বড় রাস্তার মোড়ে মোল্লাবাড়ির একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ইয়া সাইজের এক পেরেক, চুকচুক করে চুষছে। বল্টু ছেলেটাকে ডেকে বলে, ‘কিরে গাবলু, দুপুরে ভাত খাসনি? লোহা চাটছিস কেন?” গাবলু জানায় ভাত সে ঠিকই খেয়েছে। লোহা চুষে সে শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণ করেছে। স্কুলের স্যার তাকে আজ বলেছে গাবলু বাড়ি গিয়ে বেশী করে কচুশাক খাবি। কচুশাকে আয়রন আছে। আয়রন শরীরের জন্য খুব উপকারী। গাবলু হাসে। স্যারটা কি বোকা! আয়রণ উপকারী ঠিক আছে, বইতেই লেখা আছে দেখা। তাই বলে কচু শাকের মত একটা বাজে খাদ্য খেতে হবে কেন। লোহা খেলেই তো হয়! তাই গাবলু বুদ্ধি করে লোহা চুষছে। বল্টু হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরে। পারলে তো রাস্তায় শুয়ে গড়াগড়ি খায়। শান্তর এসব দেখার সময় নেই। সে বল্টুকে তাড়া লাগায়। জলদি পা ফেল। সাধুবাবার কাছ থেকে তার জীবনের গল্প শুনতে হবে। জীবন থেকে নেয়া কাহিনী নিয়ে সে গল্প লিখবে। লেখব হবে। লেখক হওয়া কি এত্ত সোজা!
দখিনা বাতাসে ঝিরিঝিরি দোলা বটপাতার আড়ালে বসে শালিকের দল লাল লাল ফল গুলো মনের আনন্দে খেয়ে চলেছে। তাদের কিচিরমিচিরে মুখর হয়ে আছে বটতলা। অল্পক্ষণেই সাধুবাবার সাথে শান্ত বল্টু খাতির করে ফেললো। শান্ত অপরিচিত মানুষের সাথে খুব সহজে মিশতে পারে না। বল্টু আগবাড়িয়ে ব্যাপারটা পানির মত সহজ করে দেওয়ায় শান্ত তার প্রতি মনে মনে অনেক কৃতজ্ঞতা বোধ করলো। সাধুবাবা মোটামুটি হাইটের লোক। গায়ে রংচঙে আলখাল্লা। গত পূজোয় ক্যানাল পাড়ে যে নাটক হলো সেখানে রাম কাকা ঠিক এরকম একটা পাঞ্জাবী পরে অভিনয় করেছিলো। বেঢপ সাইজের পাঞ্জাবী বলা যায়, মুখে ইয়া দাঁড়ি গোঁফ, মাথাভর্তি জটা চু্ল, শ্যাম্পু করেনা মনে হচ্ছে। চুলের জন্য লোকে তাকে জটা বাবা বলে। আসামের কামরুপ কামাক্ষ্যা বলে যে জায়গা আছে যেখানে মেয়েরা পোষাক পরেনা, নগ্ন হয়ে ঘোরে সেখান থেকে তিনি এসেছেন। আসলেই কি কামরূপ কামাক্ষ্যায় পোষাক না পরা মেয়ে আছে! পায়ে হেঁটে তিনি সোজা চলে এসেছেন বাংলাদেশে। গতকালমাত্র পৌঁছেছেন খুলনার এই পাঁড়াগায়ে। শান্তর একবার মনে হলো পায়ে হেঁটে সোজা কিভাবে এলো! বর্ডারে বিডিআর থুক্কু বিজিবি কি বিএসএফ বাঁধা দেয়নি! সে আর উটকো প্রশ্ন করে জটাবাবার রসভঙ্গ করতে চাইলো না। বল্টুটা একটু আগে প্রশ্ন করেছে, জটাবাবা তো আসাম থেকে এসেছেন তাহলে তার বাংলা কেন এত পরিষ্কার শোনাচ্ছে! জটাবাবা একটু বিরক্ত হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। আরে তারা তো অন্য লেভেলের লোক। সাধনা করেন। তাদের দ্বারা পৃথিবীর সব ভাষায় কথা বলা সম্ভব!
প্রস্তাব শুনে জটাবাবা খুব খুশী, গল্প বলতে তিনি ভালোবাসেন। তার ভান্ডারে আছে অজস্র অজস্র গল্প। মিজোরামের ডাউকি পাহাড়ের সেই মিজো মিলিশিয়া আর সেনাবাহিনীর বন্দুক যুদ্ধের মাঝখান দিয়ে হেঁটে আসার গল্প, ত্রিপুরার ককবরকভাষী এক তান্ত্রিকের হাতে নরবলির শিকার হওয়ার গল্প, সিলেটে সুন্দর নয়না এক মনিপুরী মেয়ের প্রেম প্রস্তাবের গল্প, কত শত গল্প আছে। সব বলবে সে। কিন্তু সে খুবই ক্ষুধার্ত। খালী পেটে কি গল্প বলে মজা পাওয়া যায়। সে শুনেছে বাংলার মানুষ খুবই অতিথি পরায়ন, কই! দুপুরবেলা তো কেউ তাকে দুমুঠো ভাত খেতে সাধলো না। শান্ত ভাবলো, তাইতো খালী পেটে কি গল্প শোনা যায়। কিন্তু সে তো টাকা নিয়ে আসেনি। বাড়িতে নিয়ে গেলে আম্মা নিশ্চিত বকাঝকা করবে। আর বড় আপা টিটকিরি মারবে। বল্টুকে জিজ্ঞেস করলো তার কাছে টাকা আছে কিনা। বল্টু মাথা নাড়ে। শান্ত এক দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটে গেলো। পদার্থ বইয়ের মলাটের ভিতর সে পাঁচশো টাকা জমিয়ে রেখেছে। নতুন একটা শান্তিনিকেতনি ব্যাগ আর পাঞ্জাবী কিনবে বলে। শান্তিনিকেতনি ব্যাগ কাঁধে নিজেকে বেশ লেখক লেখক মনে হয়! আব্বা শান্তর এই ঘনঘনন কেনাকাটা করা পছন্দ করেন না। বলেন শান্তর বয়সে তিনি দুটো শার্ট পরে বছর পার করে দিতেন। এরকম খরুচে হওয়া মোটেও ভালো না। দেশের কত মানুষ না খেয়ে আছে। সেখানে এরকম বিলাসিতা না করাই ভালো।
জটাবাবা পরিতোষের আদর্শ হিন্দু হোটেলে বসে ঠেসে কচি পাঠার ঝোল দিয়ে ভাত খেলেন। তার যা খাওয়ার বহর তাতে ইদ্রিসের ভাতঘরে নিয়ে গরু দিয়ে খেতে বসালেও খেয়ে নিত বলে মনে হচ্ছে। গ্রামদেশে পাঁচশো টাকায় কম খাওয়া যায় না। তিনি খেলেন। পেটপুরে খেলেন। পাঁচশো টাকা পুরোটা অবশ্য খাননি। চারশো নব্বই টাকা খেয়েছেন। পরিতোষের আদর্শ হিন্দু হোটেল নিয়ে ভটচার্য্যি মশাই ঘোরতর সন্দেহ প্রকাশ করেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলেন, নামেই মাত্র হিন্দু হোটেল। ‘আচার বিচার কি কিছু আছে। খাসি বলিয়া গরু চালিয়ে দিতেছে কিনা তাহাইবা কে দেখিতে যাইতেছে!’ পরিতোষের উপর ভটচার্য্যি মশায়ের প্রছন্ন বিদ্বেষের কারণ মুখ ফুটে কেউ না বললেও কারো অজানা নয়। তার বোন চারুবালা যে পরিতোষের সাথে গোপন প্রণয় করত সেজন্য কি! চারুবালার তো বছর চারেক আগে বিয়ে হয়েছে বটিয়াঘাটায়। এখন সে দুই ছেলের মা।
খাওয়া শেষ করে তারা তিনজনে আবার গাছতলায় এসে বসলো। গাছের পাতা একই ভাবে বাতাস করে চলেছে। জটাবাবা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসলেন। বল্টু আর শান্তকে কাছে ডেকে বসালেন। তাহলে গল্প শুরু করা যাক। ‘ছিলাম আসামের পাহাড়ে, তপস্যা করিয়া সময় কাটিতো সাধুবাবার আশ্রমে। জগদ্বিখ্যাত তান্ত্রিক তিনি। একদিন আমার পৃথিবী ঘুরে দেখিবার শখ হইলো। সাধুবাবাকে কহিলাম আমি জগতের বিচিত্র রূপ প্রত্যক্ষ করিতে চাই। সাধুবাবা কহিলেন, বৎস তুমি তোমার চারপাশের মানুষকে অবলোকন করো। তাহাদের মাঝেই আছে জগতের বিচিত্রতা...’ শান্ত তার ছোট নোটবুকে টুকে নিতে লাগলো সব। কিন্তু জটাবাবা হঠাৎ থেমে গেছেন। ঘুমে ঢুলু ঢুলু দুটি চোখ। এত ঠেসে খেলে তো ভাতঘুম লাগবেই। বাপরে আসামের লোকতো বাঙালীর চেয়েও বড় ভাতখোর! জটাবাবা ঘুমিয়ে গেছেন। তার নাকের আওয়াজ বটতলায় ঐকতান বাজাচ্ছে। সময় কেটে যায়। জটাবাবার নিদ্রাভঙ্গ হয় না। বল্টু সাহস করে তাকে একটা খোঁচা মারলো। জটাবাবা চোখ মেললেন। শান্ত আশা করেছিলো জটাবাবা কাঁচাঘুম ভাঙা সাধুদের মত রাগভরা রক্তিম চোখে তাকাবেন। জটাবাবা রেগেছেন ঠিক। কিন্তু চোখ লাল না। জটাবাবা শরীরটা যথাসাধ্য মুচড়ে জানালেন একটা পান খেতে পারলে শরীরের ম্যাজমেজে ভাবটা কেটে যেত।
শান্ত পান আনতে গেলো। আদর্শ হিন্দু হোটেলের তিন দোকান পরে পানওয়ালার দোকান। দোকানে পানওয়ালা নেই। তার ছেলে বসে আছে। সুরুজ, শান্তদের বয়সী, মাথার উচ্চতায় বড়, লেখাপড়ায় ঢংঢং, বাপের দোকানে থেকে এই বয়সেই বিড়ি সিগারেট খায়। নেশা করে কিনা বলতে পারবে না তবে মাঝে মধ্যে পাড়ার মেয়েদের সম্পর্কে গল্প করতে শোনা যায় তার মুখে। গল্পের সাথে মুখে বিশেষ ধরণের শব্দ করে। গত সপ্তাহে মাঠে ক্রিকেট খেলার সময় সুরুজদের দলের সাথে শান্তদের একটা ছোটখাট বচসা হয়ে গেছে। অন্যায্যভাবে তাদেরকে মাঠ থেকে বের করে দিতে চাচ্ছিলো। লিডার বুক ঠুকে দাঁড়িয়ে গেলো। লেগে গেলো ধুন্দুমার। সেই থেকে তারা সুরুজদের এড়িয়ে চলে। শান্তর ইচ্ছে করছিলো না সুরুজের দোকানে যেতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত গেলো। শান্তকে দেখে সুরুজ অপ্রসন্ন হয়েছে বোঝা গেলো। সামনে পান রেখে বললো পান নেই। শান্তকে সুর নরম করতে হলো। সে যতটা সম্ভব স্বর সংযত করে আবার পান চাইলো। সুরুজ কিছু না বলে পান বানাতে লাগলো। জিজ্ঞেস করলো জর্দা হবে? শান্ত ভাবলো পান যখন খায় তখন নিশ্চয় জর্দা খায়। সে বললো জর্দা খয়ের সব দিয়ে দাও। সুরুজ পান বানিয়ে শান্তর হাতে দিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিলো। শান্ত কেয়ার করলো না। পান নিয়ে সে গটগট করে চলে এলো।
গাছতলায় ফিরে দেখে বল্টু জটাবাবার হাত টিপে দিচ্ছে। শান্তর হাত থেকে পানের খিলিটা নিয়ে জটাবাবা মুখে পুরে চিবুতে লাগলো। তার পা খানা শান্তর কোলের উপর মেলে দিলো। শান্ত আগে কখনো কারো পা টেপেনি। প্রথমে তার হাত সরছিলো না। অনেক কষ্টে হাতের জড়তা কাটালো। জটাবাবা বলে চলেছেন, ‘...ত্রিপুরার পিশাচ তান্ত্রিক আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধিয়া ফেলিয়াছে। হাতে তাহার উদ্যত খড়গ। আমাকে কালী মায়ের চরণে উৎসর্গ করিবে। হঠাৎ আমার খুব ভয় করিলো। আমি পাঁঠার মত কাঁপিতে শুরু করিলাম। আমার ভয় কি। আমি কি কম বড় তন্ত্র মন্ত্র জানি। গুরুকে স্মরণ করিলাম...’ জটাবাবা গল্প শেষ করতে পারলেন না। খুব ঘামতে শুরু করেছেন। দরদর করে ঘামছেন। ঘামে চুলদাঁড়ি সব লেপ্টে যাচ্ছে। জটাবাবা হঠাৎ পরিচিত কন্ঠে হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘পানে কি মিশিয়ে এনেছিস হারামী! শান্ত?’ জটাবাবা হাত দিয়ে মাথা মুখ চুলকাতে গিয়ে মাথার পরচুলা খুলে ফেললো। খসে পড়লো নকল দাঁড়ি গোঁফ।
আঁতকে উঠলো শান্ত, আঁটকে উঠলো বটপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা শালিকেরা। এ যে লিডারের কন্ঠস্বর। শান্তদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। জটাবাবার মুখোশের আড়ালে চেনা মুখ যার জোড়া খাসি জবাই করে আকিকা করা নাম সাইফুল আলম। কড়া জর্দা লিডারকে ধরিয়ে দিয়েছে। এইজন্য সুরুজ ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য কিনা সেই বিষয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হতে পারে। আজকালকার জাতীয় সংসদে সাংসদদের আলোচনার বহর দেখলে তাই মনে হয়। বাজেট আলোচনার সংগীত চর্চা হীরক রাজার দেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। শান্ত কড়া চোখে বল্টুর দিকে তাকালো। বল্টু আমতা আমতা করে বললো তার কোন দোষ নেই। লিডারের গাট্টা খেয়ে এহেন মীরজাফরী কাজে সে বাধ্য হয়েছে। শান্ত নীরস গলায় বললো, ‘হুম তুমি তো এরশাদ হয়েছো। সরকার দলেও থাকো বিরোধী দলেও থাকো’। শান্ত কথা শেষ করার আগেই লিডার হড়হড় করে বমি করে দিলো। চারশো পঁচানব্বই টাকা একজোগে বেরিয়ে এলো! শান্ত রেগে থাকতে পারলো না। দৌঁড়ে গিয়ে চাপকল থেকে পানি নিয়ে এলো। লেখক পরে হওয়া যাবে। আগে লিডারের মাথায় পানি দেয়া যাক। বটফল খাওয়া রেখে শালিকগুলো নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তারা আবার কিচিরমিচির শুরু করলো। হয়তো পাশের সখীকে ডেকে বলছে, ‘দেখেছিস শালু মানুষের বাচ্চাগুলো মুখ দিয়ে টয়লেট করে!’